দক্ষিণ এশিয়ায় যুদ্ধ কি আসন্ন?
নিবন্ধটি
সাতাশ তারিখ প্রকাশিত হয়। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে চলমান সংকটের পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত
পরিবর্তিত হয়েছে। সর্বশেষ ইমরান খান কর্তৃক ভারতীয় পাইলটকে মুক্তি দেওয়ার ঘোষণার পর
পরিস্থিতি আবার নতুন করে ব্যাখ্যা করার দাবি রাখে, এই নিবন্ধের অনেক ব্যাখ্যাও পুনরায়
আলোচনা করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তারপরও আমরা মূল নিবন্ধটিই অনুবাদ করেছি।
হ্যাপিমন
জ্যাকব, আল জাজিরা:
গত
চৌদ্দ ফেব্রুয়ারি ভারতের পুলওয়ামাতে পাকিস্তান ভিত্তিক জঙ্গী সংগঠন জয়শ-ই-মুহাম্মদ
কর্তৃক হামলায় ৪০ জন ভারতীয় আধা সামরিক সৈন্য নিহত হওয়ার পর থেকেই ভারত-পাকিস্তানের
মধ্যে সামরিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছিল।
ফেব্রুয়ারির
২৬ তারিখ, ভারতীয় সামরিক বাহিনীর ভাষ্য অনুসারে একটি প্রতিশোধমূলক বিমান হামলায় তারা
পাকিস্তানের খায়বার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে একটি “জঙ্গী” প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ধ্বংস করে।
এর জবাবে পাকিস্তানও কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখায় (যা ভারত ও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরকে
আলাদা করেছে) বিমান হামলা চালিয়ে দুটি ভারতীয় যুদ্ধ বিমান ভূপাতিত করেছে বলে দাবি করে।
ভারত-পাকিস্তানের
মধ্যকার সামরিক উত্তেজনা কিংবা মুখোমুখি অবস্থান নতুন কিছু নয়, রাজনৈতিক অবস্থান ঠিক
রাখার জন্য সামরিক বাহিনীকে ব্যবহারও নতুন কিছু নয়। তবে অন্যান্য বারের সামরিক উত্তেজনার
সাথে এবারেরটার পার্থক্য হলো, ১৯৭১ এর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর এই প্রথম এক দেশ অপর
দেশের সীমান্তের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে হামলা চালিয়েছে।
অতীতে
যখনেই ভারত পাকিস্তান আক্রমণের জন্য যুদ্ধ বিমান পাঠিয়েছে (উদাহরণস্বরূপ কারগিল যুদ্ধের
সময়) তখন এ বিষয়টি নিশ্চিত করতো যে যুদ্ধ বিমান যেন কাশ্মীর নিয়ন্ত্রণ রেখার ভারতীয়
অংশে থাকে। পাকিস্তানও একইভাবে তাদের বিমান নিয়ন্ত্রণ রেখার পাকিস্তানি অংশে রাখতো।
এছাড়াও সীমান্ত পেরিয়ে যে কোন আক্রমণ হলে সেটা বিতর্কিত ভূখণ্ড পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত
কাশ্মীরে হতো, মূল পাকিস্তানে হতো না। উদাহরণস্বরূপ ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের উরি
আর্মি ক্যাম্পে হামলার জবাবে ২০১৬ সালে সংগঠিত সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের কথা বলা যায়।
ভারতের
দিক থেকে বিবেচনা করলে এই আক্রমণের পিছনে তাদের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন একটি বড় কারণ
হতে পারে, এর বিপরীতে পাকিস্তান এরকম বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়িয়ে যেতে চাচ্ছে, এবং ভবিষ্যতে
যাতে নির্বাচন উপলক্ষে পাকিস্তান আক্রমণ রুটিনে পরিণত না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে চাচ্ছে।
একপক্ষ নতুন করে তাদের সামরিক ভাবমূর্তি তৈরি করতে চাচ্ছে, আরেক পক্ষ মনে প্রাণে এড়িয়ে
যেতে চাচ্ছে।
এটা ভারতের নির্বাচনের মৌসুম
কারগিল সংকটের
পর থেকে দুই দশকের মধ্যে এই দুই পক্ষের মধ্যে এটিই সবচেয়ে গুরুতর সামরিক উত্তেজনা, তার উপর সামনে ভারতের জাতীয় নির্বাচন আর সেখানকার চতুর প্রধানমন্ত্রী
নরেন্দ্র মোদি দ্বিতীয় বারের মতো গদিতে বসতে চাচ্ছেন বলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে পড়েছে।
মোদি
সরকার সবসময় নিরাপত্তার বিষয়ে তাদের কঠোর অবস্থানের কথা বলে থাকে, কাজেই ১৪ ফেব্রুয়ারির
পুলওয়ামা হামলার কড়া জবাব না দিয়ে থাকা মোদি সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। এই হামলার জবাব
না দিলে মোদি এবং তার ডানপন্থী দলের জন্য তা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণ হতো, বিশেষত
বিরোধী দলের পক্ষ থেকে জবাব দেওয়ার জন্য আহ্বান করার পর এবং গত বছরের গুরুত্বপূর্ণ
উপ-নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টির হতাশাজনক ফলাফলের পর পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে গেছে।
পুলওয়ামা
হামলা মোদির জন্য রাজনৈতিক সুযোগ নিয়ে এসেছে এবং তিনি এ সুযোগের যথাসম্ভব সদ্ব্যবহার
করতে চাইবেন। এজন্য তিনি হয়তো পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আরো উত্তেজনা সৃষ্টি করতে চাইতে
পারেন।
পাকিস্তানের
প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের জন্য এরকম বহুলপ্রচারিত ভারতীয় আক্রমণের জবাব না দেওয়াটা
রাজনৈতিক আত্মহত্যার নামান্তর। অন্যদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্যও জবাব না দেওয়াটা
তাদের জনপ্রিয়তার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, তাদের সাধারণ সৈন্যদের মনোবল ভেঙে দিতে পারে।
এরপর কী?
আজ
(সাতাশ ফেব্রুয়ারি) সকালে, পাকিস্তান ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের আকাশে বিমান হামলা
করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। খুব সহজেই বলা যায়, ভারত পাল্টা আক্রমণ করবে এবং উভয় পক্ষ তাদের
সীমান্তে লড়তে থাকবে।
প্রদত্ত
পরস্পর বিরোধী প্রতিবেদনের আলোকে আকাশ যুদ্ধের মাত্রা পরিমাপ করাটা আসলে অনেক কঠিন।
উভয় পক্ষই দাবি করছে যে তার প্রতিপক্ষের যুদ্ধ বিমান ভূপাতিত করেছে। কতটি যুদ্ধবিমান
ভূপাতিত হয়েছে, পাইলট গ্রেপ্তার হয়েছে কিনা, কোন পক্ষের কতটুকু ক্ষতি হচ্ছে, এসব সম্পর্কেও
পরস্পর বিরোধী তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
যে
বিষয়টি পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলবে তা হলো আটককৃত পাইলটের সাথে কেমন আচরণ করা হচ্ছে,
তাকে ফেরত দেওয়া হচ্ছে কিনা, এবং মোটা দাগে বিমান হামলার ফলে ভারতীয় অংশে কতটুকু ক্ষয়-ক্ষতি
হচ্ছে।
ভারতীয়
বিমান হামলার ঘটনায় পাকিস্তানও নিয়ন্ত্রণরেখায় তাদের ভারি কামানগুলো সক্রিয় করেছে।
এ কৌশলটি ইতোপূর্বে উত্তেজনা বৃদ্ধিকালে উভয়পক্ষই ব্যবহার করেছে। একদিন পর নয়া দিল্লি
ও ইসলামাবাদ হয়তো নিয়ন্ত্রণরেখায় আগ্নেয়াস্ত্রে পরিমাণ আরো বৃদ্ধি করতে পারে।
এই
উত্তেজনা কত দূর যেতে পারে তা এখনো অস্পষ্ট। ভারত যদি আবার পাল্টা আক্রমণ করে, তবে
খুব সম্ভ আবার বিমান হামলাই করবে, সেক্ষেত্রে উভয় পক্ষ একটি অজ্ঞাত সংঘাতের মধ্যে নিজেদেরকে
আবিষ্কার করবে, যদি না পাকিস্তান সেসময় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
ইসলামাবাদের
হাতে অবশ্য আরেকটি বিকল্প আছে। চাইলে তারা সামরিক জবাব কমিয়ে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে
ভারতীয় লক্ষ্যবস্তুতে আরো বেশি আক্রমণের সুযোগ করে দিতে পারে। ইসলামাবাদ এর আগেও এ
কৌশল অবলম্ব করেছিলো। ২০১৬ সালের ভারতীয় সার্জিক্যাল অ্যাটাকের পর, ভারত নিয়ন্ত্রিত
কাশ্মীরে জঙ্গী হামলার তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। তবে এ কৌশল পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী
কিংবা সেনাবাহিনীর জন্য সম্ভবত কোন ফায়দা বয়ে আনবে না।
এটা
মনে রাখা জরুরি, এটি মোদি ও খানের ভাবমূর্তির যুদ্ধও বটে। ফলে উত্তেজনা হ্রাস করাটা
নির্ভর করবে যুদ্ধ থেকে ফিরে গিয়ে জনগণের সামনে তাদের মুখরক্ষা করার সক্ষমতার উপর।
অর্থাৎ যুদ্ধ থেকে বিরত হতে হলে এমনভাবে হতে হবে, যাতে আম জনতার সামনে নিজেদের ভাবমূর্তি
রক্ষা করা সম্ভব হয়। উভয় প্রধানমন্ত্রীর এই সক্ষমতার উপর চলতি সংকট নিরসন বহুলাংশে
নির্ভর করবে।
________________________________