বর্ণবাদের মোকাবেলা শ্বেতাঙ্গদের প্রয়োজনীয়তা ও অনুভূতির বিষয় নয়...
আইজেমা ওলুও, দ্য গার্ডিয়ান:
ভেবেচিন্তে কীভাবে বর্ণ নিয়ে কথা বলতে
হয়
–
পুরো দিন ধরে সে বিষয়ে কর্মশালা পরিচালনা করে দিন শেষে আমি একটি বাণিজ্যিক কার্যালয়
থেকে বের হচ্ছিলাম। এর আগে আমি অনেকগুলো কর্মশালায় যেরকমটা দেখেছি, এ দিনের সেশনসমূহের
দর্শকরাও একই রকম ছিলেন। সেখানে অশ্বেতাঙ্গদেরকে বাড়িয়ে উপস্থাপন করা হচ্ছিল, এবং সাদা
কর্মীদের কম করে উপস্থাপন করা হচ্ছিল। অশ্বেতাঙ্গ অংশগ্রহণকারীরা সাধারণত আমার সাথে
চোখে চোখে যোগাযোগ করছিলেন, আমিও সাড়া দিচ্ছিলাম – তাদের মুখে আমি
মাঝে-মধ্যে “তাই তো, তাই তো” জাতীয় শব্দ শুনছিলাম – তবে কখনোই প্রশ্ন
কিংবা কোন মন্তব্য করার জন্য প্রথমে হাত তুলছিলেন না। এদিকে শ্বেতাঙ্গরা সব সময় তাদের
মতামত আমাদের সামনে পেশ করতে বেশ আগ্রহী ছিলেন। এধরনের সেশনে আমি শ্বেতাঙ্গদের জোর
কণ্ঠস্বরকে সমন্বয় করার পাশাপাশি সাধারণত ঠিক পথে এগুচ্ছি কি না সেটা নিশ্চিত করার
জন্য অশ্বেতাঙ্গদের নীরব প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করি।
সভাকক্ষে প্রবেশ পথে একজন এশীয় মহিলার
সাথে আমার চোখাচোখি হলো, তিনি বললেন, “ধন্যবাদ।” একজন কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ আমার কাঁধ চাপড়ে
বললেন, “মেয়ে, তুমি যদি জানতে!” আরেক কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা আমাকে থামিয়ে চারদিকে সতর্ক চোখে
তাকিয়ে নিশ্চিত হলেন যে কেউ শুনতে পাচ্ছে কি না, তারপর বললেন, “তুমি সত্য কথা বলেছ।
আমার ইচ্ছা হচ্ছে আমি যদি আমার গল্প তোমার সাথে আলোচনা করতে পারতাম, তাহলে তুমি বুঝতে
পারতে যে তুমি কতখানি সত্য। কিন্তু এসব আলোচনার জন্য এটা সঠিক জায়গা নয়।”
সেটা সঠিক জায়গা ছিল না। এসব সেশনে অশ্বেতাঙ্গদের
দিকে মনযোগ দেওয়ার জন্য এবং তাদেরকে নিরাপদ রাখার জন্য আমি যত্নশীল হওয়া সত্ত্বেও সেটা
সঠিক জায়গা ছিল না। আবারো, অশ্বেতাঙ্গদের সত্যিকারের বিপদের আলোচনা শ্বেতাঙ্গদের অনুভূতি
সম্পর্কে, তাদের প্রত্যাশ্যা সম্পর্কে, তাদের চাহিদা সম্পর্কে আলোচনার মাধ্যমে চুপসে
গেছে।
যেহেতু আমি সেখানে দাঁড়িয়ে বর্ণ সম্পর্কে
শত শত কণ্ঠ রোধ করে দেওয়া কথোপকথনের স্মৃতি রোমন্থন করছিলাম, এক সাদা মহিলা আমার মনযোগ
ফেরালেন। আশেপাশের কেউ তার কথা শুনে ফেলছে কি না, সেটা নিয়ে তিনি মোটেও চিন্তিত ছিলেন
না। আমার হাতে তার সাথে কথা বলার সময় আছে কি না, সেটাও তিনি আমাকে জিজ্ঞাস করছিলেন
না, যদিও আমি দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলাম।
“তোমার আলোচনা আসলেই চমৎকার হয়েছে,” তিনি
তার কথা শুরু করলেন। “তুমি অনেক ভালো ভালো কথা বলেছ, যেগুলো প্রচুর মানুষের জন্য উপকারী
হবে।”
তিনি একটু থামলেন, এরপর আবার বললেন, “কিন্তু
বিষয় হলো, তুমি আজ এমন কিছুই বলো নি, যে আরো বেশি কৃষ্ণাঙ্গ বন্ধু বানাতে আমকে সহযোগিতা
করবে।”
একেবারে শুরুর দিকে বর্ণবাদ নিয়ে আলোচনায়
আমি যোগদান করেছিলাম, এমন একটি প্যানেলের কথা মনে পড়লো। সিয়াটল শহরে (ওয়াশিংটন রাজ্যের
একটি শহর) একজন কালো লোককে এক নিরাপত্তারক্ষী পিপার স্প্রে করেছে, তার অপরাধ শুধু এতোটুকু
ছিল যে তিনি একটি শপিং সেন্টারের দিকে হাটছিলেন। ঘটনাক্রমে সেটা ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল।
একদল কালো লেখক-অ্যাক্টিভিস্ট – এদের মধ্যে আমিও ছিলাম – সিয়াটলের সংখ্যাগরিষ্ঠ
শ্বেতাঙ্গদের সামনে সে ঘটনা নিয়ে কথা বলছিলাম। আমার সাথে থাকা প্যানেলিস্ট চার্লস মুডেড,
যিনি একাধারে একাধারে একজন মেধাবী লেখক, ফিল্ম মেকার এবং অর্থনৈতিক তাত্ত্বিক, কর্মক্ষেত্রে অর্থনৈতিক পদ্ধতির কথা উল্লেখ করে বলছিলেন: এই
নিরাপত্তারক্ষীকে বলে দেওয়া হয়েছে যে তার দায়িত্ব হলো তার নিয়োগকর্তার লাভ করার
সক্ষমতাকে রক্ষা করা। তাকে বলা হয়েছে যে তার দায়িত্ব হলো শুধু সেসকল ক্রেতাদেরকে রাখা, যাদের সুখে স্বাচ্ছন্দে ও নিরাপদে ব্যয় করার মতো টাকা আছে। আর
কার টাকা আছে কার টাকা নাই, কে সহিংস, কে সহিংস নয়, সে সম্পর্কে প্রতিদিন তাকে সাংস্কৃতিক
বার্তা গেলানো হচ্ছে। চার্লস যুক্তি দেখান যে নিরাপত্তারক্ষী শুধুমাত্র তার দায়িত্ব
পালন করেছিল। একটি শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদী পুঁজিবাদী ব্যবস্থায়, আপনার কাজটি ঠিক এরকমই
দেখায়।
যাক, তিনি অন্তত এই অবস্থানে যুক্তি দাঁড়
করার চেষ্টা করছিলেন। কারণ মাঝপথে এক সাদা মহিলা দাঁড়িয়ে তাকে আটকালেন।
“দেখ, আমি নিশ্চিত যে তুমি এসকল স্টাফ সম্পর্কে প্রচুর
জানো।” সে মহিলা কোমরের উপর হাত রেখে বলছিলেন, “কিন্তু আমি এখানে অর্থনীতির পাঠ শেখার
জন্য আসি নি। আমি এসেছি কারণ এই লোকটির প্রতি যা ঘটেছে, সেটাতে আমার খারাপ লেগেছে এবং
আমি জানতে চাই যে এখন কী করার আছে।”
হয়তো, সেই আলোচনা কক্ষও সঠিক জায়গা ছিল
না। সেই মহিলার কথা অনুসারে, উপরের এলাচনা হওয়া উচিত হয় নি, পিপার স্প্রে দ্বারা যাকে
আক্রমণ করা হয়েছে তার অনুভূতি অথবা আরো বৃহদাকারে কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের অনুভূতি আলোচনা
করাটা যথোপযুক্ত ছিল না। যদিও আমরা নিজেরা নিজেদের শহরে কতটা অনিরাপাদ, সে আলোচনা সেটারই
প্রমাণ ছিল মাত্র। সেই মহিলার খারাপ লেগেছে এবং তিনি তার খারাপ লাগা বন্ধ করতে চান।
আর তিনি আমাদের নিকট প্রত্যাশা করেন আমরা কার সেই খারাপ লাগা বন্ধ করে দেব।
গত মাসে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি আলোচনা
করছিলাম প্রকাশনার ‘শ্বেত ধোলাই’ সম্পর্কে, এবং অশ্বেতাঙ্গদের আরো বেশি ছাকনিবিহীন
(অর্থাৎ কোন ধরনের কাট-ছাট ব্যাতিরেখে) আখ্যানের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে, একজন সাদা ভদ্রলোক
বেশ জোর গলায় বললেন, আমরা (কৃষ্ণাঙ্গরা) যদি নিজেদেরকে আরো সহজবোধ না করি, তাহলে শ্বেতাঙ্গদের
পক্ষে আমাদেরকে বোঝার কোন উপায় নেই। আমি যখন তাকে জিজ্ঞাস করলাম, শুধুমাত্র নিজেদেরকে
খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য অশ্বেতাঙ্গরা শ্বেত সংস্কৃতির সকল উপাদানের সাথে নিজেদের অভ্যস্ত
করে তুলতে হবে কি না, তখন তিনি মাথা ঝাঁকালেন এবং তার নোটবুকের দিকে তাকালেন। গত সপ্তাহে
আমার পরিচালিত একটি কর্মশালায় এক সাদা মহিলা সন্দেহ প্রকাশ করে বললেন আমেরিকার অশ্বেতাঙ্গরা
বর্ণ সম্পর্কে সম্ভবত অতি মাত্রায় সংবেদনশীল। তিনি কীভাবে জানতে সক্ষম হবেন, যদি আমরা
তার প্রশ্নে সব সময় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি।
অসংখ্য বার আমি এ রকমের বাধা এবং উত্তরের
অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। এমনকি যখন পোস্টারে আমার নাম লেখা থাকে, তখনো সেসকল জায়গাকে
আমি এবং আমার মতো অশ্বেতাঙ্গ লোকজন যেসকল বিষয়ে কথা বলা প্রয়োজন মনে করি সেকল কথার
জন্য সঠিক জায়গা বলে মনে হয় না। সুতরাং প্রায়ই কোন বিষয়ে আলোচনা হবে, তারা কী শুনবে,
কী জানবে, সেটা সম্পর্কে শ্বেতাঙ্গ উপস্থিতিই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এবং এটা তাদের জায়গা,
সব জায়গাই তো তাদের।
একদিন, হতাশা হয়ে, আমি সামাজিক মাধ্যমে
এই স্ট্যাটাস পোস্ট করি:
“যদি তোমার বর্ণবাদ বিরোধী কাজে শ্বেত আমেরিকার
‘প্রবৃদ্ধি’ এবং ‘আলোকোদ্ভাসিত দিক’ অশ্বেতাঙ্গদের নিরাপত্তা, মর্যাদা এবং মানবতার
উপর প্রাধান্য পায়, তাহলে এটি বর্ণবাদ বিরোধী কাজ নয়। এটি বরং শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদী
কাজের অংশ।”
শ্বেতাঙ্গদের নিকট প্রাপ্ত একেবারে শুরুর
দিকের মন্তব্যগুলোর একটি ছিল: “ঠিক আছে, কিন্তু কোন কিছু না হওয়ার চেয়ে এটা কি ভালো
নয়?”
আসলই কি তাই? সামান্য মুছে ফেলা অনেক বেশি
মুছে ফেলার চেয়ে ভালো নাকি? বর্ণবাদ বিরোধী কাজের ফাঁকে সামান্য শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদ
কোন বর্ণবাদ বিরোধী কাজই না হওয়ার চেয়ে ভালো? আমেরিকায় জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে আমি
যখনই দাঁড়াই, আমি জানি যে আমার সামনে প্রচুর শ্বেতাঙ্গ আছে, যারা এখানে এসেছে বর্ণবৈষম্য
ও সহিংসতার খবর পড়ে একটু কম খারাপ লাগার জন্য, সবাইকে একথা জানানোর জন্য যে তারা অন্যদের
মতো নয়, আরো কালো বন্ধু বানানোর জন্য। এসবই তাদের উপস্থিতির উদ্দেশ্য। আমি জানি আমি
এমন প্রচুর শ্বেতাঙ্গের সামনে কথা বলছি, যারা মনে করে তারা সমস্যার অংশ নয়, যেহেতু
তারা এখানে উপস্থিত হয়েছে।
শুধু একটি বার আমি এমন একদল শ্বেতাঙ্গের
সামনে কথা বলতে চাই, যারা জানে যে তারা এখানে এসেছে কারণ তারা এই সমস্যার অংশ। যারা
জানে যে তারা এখানে এসেছে, যাতে তারা কোন কোন জায়গায় ভুল করছে, ক্ষতিকর কাজ করছে সেটা
জেনে আরো ভালো কাজ করতে শুরু করতে সক্ষম হয়। কারণ শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদ তাদেরই গড়া,
এটি থেকে তারা উপকৃত হয়েছে, এবং এটি ধ্বংস করা তাদেরই দায়িত্ব।
আমি এবং আরো অনেক অশ্বেতাঙ্গ অংশগ্রহণকারী
প্রায়ই ক্লান্ত এবং হতাশ হয়ে এসব আলোচনা বাদ দিয়ে দিই, তবে আমি এখনও সবাইকে স্পষ্ট
করে বাস্তব অবস্থা দেখাই এবং কথা বলি। আমি বাস্তব অবস্থা দেখিয়ে দিতে থাকি এই আশায়
যে, হয়তো এই আলোচনা শেষ পর্যন্ত অচলায়তন ভাঙবে, অথবা আমাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাবে,
যেটা আমার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের আরো কাছাকাছি। আমি সেসকল কৃষ্ণাঙ্গের জন্য কথা বলি, যারা
মুক্তভাবে কথা বলতে পারে না, যাতে করে তাদেরকে সবাই দেখতে পায়, শুনতে পায়। আমি কথা
বলি, কারণ এই কক্ষে থাকা কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে যাদের শুনা দরকার যে বর্ণবাদী নিপীড়নের
বোঁঝা তাদের বহন করা উচিত নয়, যেখানে এই নিপীড়ন থেকে যারা উপকৃত হয়, তারা প্রত্যাশা
করে যে বর্ণবাদ বিরোধী প্রচেষ্টায় প্রথমে তাদের চাহিদা পূর্ণ করা হবে। আমার একেবারে
সাম্প্রতিক আলোচনার পর, এক কালো মহিলা আমার নিকট একটি নোট পাঠান যেখানে তিনি লিখেছিলেন
যে বর্ণবাদ তার জীবনে কী রকম প্রভাব ফেলছে তিনি কখনোই তার শ্বেত সহকর্মীদের নিকট থেকে
প্রতিশোধের ঝুঁকি ছাড়া সেটা খোলামেলা আলোচনা করতে পারেন না। “আমি বাড়িতে নীরব থেকেই
আরোগ্য লাভ করি,” এভাবেই তিনি তার কথা শেষ করেন।
এটা কি কোন কিছু না হওয়া থেকে উত্তম? নাকি
বাস্তবতা এই যে ২০১৯ সালেও প্রতিদিন নিজেকে সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রশ্নটি করতে হচ্ছে যে
________________________________
নিবন্ধটি দ্য
গার্ডিয়ানে “Confronting
racism is not about the needs and feelings of white people” শিরোনামে প্রকাশিত
হয়। ভাষান্তর কর্তৃক অনূদিত, দ্য গার্ডিয়ান থেকে ছবি সংগৃহীত।