নেতানিয়াহু মানেই যুদ্ধ!
ফাওয়াজ এ. গের্জেস, প্রজেক্ট সিন্ডিকেট:
একটি তিক্ত নির্বাচনী প্রচারাভিযানের পর ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বিনইয়ামিন নেতানিয়াহু শান্তিবাদী নেতার চেয়ে আধিপত্যবাদী নেতা হিসেবেই তার নিজের অবস্থানটাকে সুরক্ষিত করেছেন। গত এক দশক ধরে তিনি ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনিদের মধ্যে কোন ধরনের সমন্বয় সাধনের সম্ভাবনাকে একেবারে ধ্বংস করে দিয়েছেন, এমনকি অভ্যন্তরীণ বিষয়েও ইসরায়েলকে গভীরভাবে বিভক্ত করে ফেলেছেন।
মধ্যপ্রাচ্যে যারা শান্তি প্রত্যাশা করেন, তাদের প্রত্যেকেরই নেতানিয়াহুর এ রকম নীতির ধারাবাহিকতার ব্যাপারে গভীরভাবে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হওয়া উচিত, এ সকল নীতির ফলাফল আগামী কয়েক দশক ধরে অনুভব করতে হবে। অধিকৃত অঞ্চলসমূহকে ইসরায়েলের অন্তর্ভুক্ত করা, আরব ইসরায়েলিদেরকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা এবং নিষ্ঠুরভাবে ফিলিস্তিনি জনগণের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ প্রভৃতি নীতি ইসরায়েল এবং তার প্রতিবেশীদের মধ্যে চিরস্থায়ী সংঘাতের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এমনকি আরো আশঙ্কাজনক বিষয় হলো,
সাংস্কৃতিক যুদ্ধ নিয়ে নেতানিয়াহুর বাগাড়ম্বর ভূমির মালিকানার সংঘাতকে “সভ্যতার সংঘাতে” রূপান্তরিত করতে পারে। যা সব পক্ষের চরমপন্থীদেরকে আরো উৎসাহ প্রদান করবে।
নেতানিয়াহু ইসরায়েলকে একটি একচোখা গণতন্ত্রে পরিণত করছেন। ভীতি ও বর্ণবাদ ছড়ানোর মধ্য দিয়ে তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ ইহুদি সম্প্রদায় ও ইসরায়েলি আরব সম্প্রদায়ের মধ্যে স্থায়ী বিরোধ সৃষ্টি করতে চেয়েছেন। উল্লেখ্য ইসরায়েলি আরব সম্প্রদায় দেশের মোট জনসংখ্যার ২০%। (এদের মধ্যে মুসলিম ও খৃষ্টান— উভয় ধর্মের মানুষই আছেন, তবে বেশির ভাগই মুসলিম। -অনুবাদক)
উদাহরণস্বরূপ গতবছর নেতানিয়াহু একটি “জাতিরাষ্ট্র আইন”
করেছেন, যা ইহুদিদেরকে আত্মনির্ভরশীলতার “একক” অধিকার প্রদান করে, এবং একইভাবে আরব ইসরায়েলিদেরকে আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করে। ইসরায়েলি অভিনেতা রোতেম সেলা এই আইনের সমালোচনা করলে নেতানিয়াহু তার জবাবে বলেছিলেন “জাতি রাষ্ট্র, তবে সকল নাগরিকের জন্য নয়, বরং শুধু ইহুদিদের জন্য।” এই প্রকাশ্য শত্রুতার পর, ২০১৫ সালের নির্বাচনের তুলনায় এবারের নির্বাচনে আরব ইসরায়েলিদের উপস্থিতি ১৫ শতাংশ কম ছিল, তা খুব বেশি বিস্ময়কর কিছু নয়। যখন আপনার দেশের প্রধানমন্ত্রী কোন ধরনের শর্ত ছাড়াই আপনাকে দেশের রাজনৈতিক সম্প্রদায়ে সমান মর্যাদার অধিকারী নয় বলে ঘোষণা করেন,
তখন সে দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণটাকে নিরর্থক বিষয় মনে হতেই পারে।
দেশের ভিতরে গণতন্ত্র হ্রাসের পাশাপাশি, নেতানিয়াহু শান্তি প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্থ করেছেন এবং ইসরায়েলের দীর্ঘ মেয়াদি নিরাপত্তাকে বিপন্ন করেছেন। যদিও তিনি ইসরায়েলকে নিরাপদ ও শক্তিশালী করার ব্যাপারে প্রায়ই আত্মশ্লাঘায় ভোগেন, কিন্তু তার কাছে নিরাপত্তার মানে এতোটাই সংকীর্ণ ও স্বল্পমেয়াদি যে কার্যত এটা অর্থহীনই। তার সকল পদক্ষেপই স্বল্পকালীন হিসাব নিকাশ ও ক্ষমতার ভারসাম্য ঠিক রাখাকে কেন্দ্র করে,
এর বিনিময়ে তিনি প্রকৃত শান্তিকে বলি দিচ্ছেন। শক্তিশালী আরব মিত্ররা ইসরায়েলকে দীর্ঘস্থায়ী নিরাপত্তা দেবে না। শুধুমাত্র আরব বিশ্বের জনগণের সাথে শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই ইসরায়েল দীর্ঘস্থায়ী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। তবে দীর্ঘস্থায়ী নিরাপত্তার স্বার্থে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে আরব জনগণের সাথে, স্বৈরশাসকদের সাথে নয়।
শেষমেশ তখনই সত্যিকারের নিরাপত্তা অর্জিত হবে,
যখন ইসরায়েলিরা এবং ফিলিস্তিনিরা তাদের মধ্যকার শতাব্দি-প্রাচীন সংঘাত নিরসনের পথ খোঁজে পাবে,
এবং পাশাপাশি বসবাস করতে রাজি হবে, সেটা দুই রাষ্ট্রেই হোক, আর একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই হোক। এছাড়া আর কোন টেকসই সমাধান নেই। যতদিন অবধি ফিলিস্তিনিরা নির্যাতিত হতে থাকবে, এবং তাদের নিজস্ব রাষ্ট্রে অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকবে, ততদিন অবধি সংঘাত চলতে থাকবে।
এছাড়াও, গত ১৩ বছরে নেতানিয়াহু অধিকৃত পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে ইহুদি বসতি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রবল উদ্যোমে সমর্থন দিয়ে গেছেন। তিনি ভালো করে জানেন যে এসকল বসতি স্থায়ী ও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পথে প্রত্যক্ষরূপে কঠিন বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
তাছাড়া সাম্প্রতিক নির্বাচনী প্রচারণা চলাকালে নেতানিয়াহু প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে তিনি পুনঃনির্বাচিত হলে
“পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণ” করার মাধ্যমে পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা প্রতিহত করবেন। তার কথাকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। পশ্চিম তীরকে অন্তর্ভুক্তকরণের প্রতিশ্রুতি তার দীর্ঘ দিন ধরে দুই-রাষ্ট্র সমাধানের বিরোধিতা করার ইতিহাসের সাথে সামঞ্জস্যশীল। নতুন করে নির্বাচিত হয়ে, এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সাহেবের নিঃশর্ত সমর্থন নিয়ে তিনি কল্যাণার্থে ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি শান্তির প্রত্যাশাকে কফিনে ঢুকাতে এখন আরো বেশি সাহসী ভূমিকা পালন করবেন।
নেতানিয়াহুর গৃহীত পদক্ষেপসমূহ যত বেপরোয়াই হোক না কেন, তাকে খুব বড় ধরনের কোন বাধার মুখোমুখি হতে হবে না। ইসরায়েলের মধ্যপন্থী রাজনৈতিক শক্তি নাটকীয়ভাবে ডানে চলে এসেছে, আর তার নিজের জোট কট্টর জাতীয়তাবাদী দলগুলো নিয়ে গঠিত,
যেগুলো ফিলিস্তিনি ভূমি ইসরায়েলের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য চাপ দিচ্ছে। তিনি এখন হয়তো নিজের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে নিজেকে বাঁচানোর স্বার্থে তাদের দাবি সমূহকে আইনি প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়িত করবেন।
বারাক ওবামা যেখানে নেতানিয়াহুর চরমপন্থী প্রবণতাকে দমন করে রেখেছিলেন, ট্রাম্প সাহেব সেখানে তাকে আরো সাহস যোগাচ্ছেন। নির্বাচনে নেতানিয়াহুকে সহযোগিতা করার নিয়তেই ট্রাম্প সাহেব সিরিয়ার গোলান মালভূমিতে ইসরায়েলের সার্বভৌমত্বের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছেন। পরে গর্বভরে বলেছিলেন, তিনি তার জামাতা জারেদ কুশনারের নিকট থেকে ইতিহাসের “দ্রুত” পাঠ গ্রহণের পর এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। এরপর সিএনএন যখন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওকে জিজ্ঞেস করলো, পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার বিষয়ে নেতানিয়াহুর বক্তব্য ট্রাম্প প্রশাসনের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত শান্তি পরিকল্পনাকে বাধাগ্রস্থ করবে বলে আপনি মনে করেন নি না, পম্পেও সাহেব স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলেন “আমি এরকম মনে করি না।”
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই জবাব থেকে বোঝা যায় যে যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে নেতানিয়াহুকে পূর্ণ ক্ষমতা প্রদান করা হবে এবং ট্রাম্প প্রশাসন স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠারি আাহ্বান জানাবে না। তার মানে শান্তি প্রক্রিয়া শেষ, নেতানিয়াহুই বিজয়ী। স্পষ্টতই, ট্রাম্প এবং নেতানিয়াহু একই রাজনৈতিক মুদ্রার দুই পিঠ। তারা তাদের রক্ষণশীল গণভিত্তির সন্তুষ্টি অর্জনের স্বার্থে যে কোন কিছু করতে পারেন, ভুল না সঠিক সে প্রশ্ন তাদের হিসাবে থাকবে না।
ফিলিস্তিনিদের বাদ দেওয়া হয়েছে। ফিলিস্তিনের নেতৃত্ব অতি মাত্রায় দুর্বল ও বিভক্ত, তাদের পক্ষে ইসরায়েলের দখলদারিত্ব ও বসতি সম্প্রসারণ প্রতিহত করা সম্ভব নয়। সৌদি আরব ও অন্যান্য প্রভাবশালী আরব রাষ্ট্রসমূহ, যারা এক সময় ফিলিস্তিনিদের সমর্থন যুগিয়েছিল, এখন তাদের ইসরায়েল নীতিতে ফিলিস্তিনের বদলে ইরান বেশি গুরুত্ব পায়।
এরপরও সংঘাত এখনো অনিবার্য নয়, এমনকি ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি সমস্যা অবশেষে সমাধান হতেও পারে। কিন্তু সেটা হতে হলে অবশ্যই দুই পক্ষের মধ্যে সেতুবন্ধন দরকার। এ অঞ্চলে ইসরায়েলে সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ এবং মধ্য প্রাচ্যের প্রতিবেশীদের সাথে ইসরায়েলের প্রকাশ্য মিলন সব সময়ই ফিলিস্তিনিদের সাথে সমন্বয় সাধনের উপর শর্তযুক্ত থাকবে।
ফিলিস্তিনিদের সাথে বোঝাপড়ায় আসার ব্যাপারে নেতানিয়াহু কোন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। তার বর্ণবাদী নীতি এবং ফিলিস্তিনিদের প্রতি বর্বরতা বিভক্তিকে আরো গভীর করবে, সেতুবন্ধন তৈরি করবে না। তিনি যে পথে আছেন, কেবল যুদ্ধ আর আরো অনেক দুর্ভোগের মাধ্যমেই সে পথের সমাপ্তি হতে পারে।
________________________________
লেখক লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স অ্যান্ড পলিটিকাল সায়েন্সের অধ্যাপক। নিবন্ধটি প্রজেক্ট সিন্ডিকেটে “Netanyahu
Means War” শিরোনামে প্রকাশিত হয়। ছবি: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে সংগৃহীত।